Education | শিক্ষাশিক্ষা

শিক্ষায় আমূল পরিবর্তন

Rate this post

সামনে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে আবারও আমূল পরিবর্তন আসছে শিক্ষাক্রমে। ২০১০ সালে প্রণয়ন করা ন্যাশনাল পারসপেকটিভ প্ল্যান আধুনিকায়ন করার পাশাপাশি চূড়ান্ত হবে শিক্ষা আইন। মুখস্থবিদ্যা বাদ দিয়ে আসছে অভিজ্ঞতাভিত্তিক (কারিগরি) শিক্ষাব্যবস্থা।

দেশের এই নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে আগামী বছর থেকে পাইলট প্রকল্প শুরু হবে। আর এ শিক্ষাক্রম পুরোপুরি শুরু হবে ২০২৩ সালে। নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী নবম ও দশম শ্রেণিতে বিষয়ের বিভাজন থাকবে না।

আগে নবম ও দশম শ্রেণির পাঠ্যক্রম মিলিয়ে পাবলিক পরীক্ষা হলেও, নতুন পাঠ্যক্রমে শুধু দশম শ্রেণিতে পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। নবম ও দশম শ্রেণির বইও হবে আলাদা।

সোমবার (১৩ সেপ্টেম্বর) জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা উপস্থাপন শীর্ষক প্রেস কনফারেন্সে এসব তথ্য জানান শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি।

এইচএসসি পর্যন্ত পাস করতে চারটি পাবলিক পরীক্ষায় পাস করার যে বিধান সরকার চালু করেছে তা ২০১০ সালে প্রণীত। অগণতান্ত্রিক জাতীয় শিক্ষানীতির প্রাথমিক খসড়াতে ছিল না এ বিধান। শিক্ষানীতিতে পাবলিক পরীক্ষার সংখ্যা ছিল দুটি।

পরবর্তীতে নিজেদের সুবিধামতো শিক্ষানীতি সংশোধন করে এবং সর্বশেষ শিক্ষা আইন করে পিইসি এবং এসএসসি পরীক্ষার বৈধতা তৈরি করছে সরকার। সরকারের এই পরিকল্পনার পেছনে রয়েছে শিক্ষাসম্পর্কিত বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি।

স্বাধীনতা পরবর্তীসময়ে বাংলাদেশের প্রত্যেকটি সরকার শিক্ষাকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়েছে, শিক্ষাকে করেছে ব্যয়বহুল। ‘পড়াশোনা করতে টাকা লাগবে’-এই ধারণা ব্যাপকভাবে বিস্তৃত করা হয়েছে। বর্তমান সরকার তাদের শিক্ষানীতি এবং অন্যান্য পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে এই প্রক্রিয়াকে কেবল ত্বরান্বিতই করছে।

পিইসি-জেএসসি চালু করার পর ব্যাপক বাণিজ্যিকীকরণ শুরু হয়েছে একদম স্কুলপর্যায় থেকেই। স্কুলে চালু করা হয় বাধ্যতামূলক কোচিং। অব্যাহত পরীক্ষার চাপ সামাল দিতে শিশুরা গাইড বই ও প্রাইভেট টিউশনির দিকে আরো বেশি ঝুঁকে পড়ে।

অবস্থা এমন হয়েছে, অনেক অভিভাবক একদম শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই শিশুদের কোচিং-এ দিচ্ছেন। ফলে শিক্ষা ব্যয় বেড়েছে কয়েকগুণ। অন্যদিকে শিক্ষার মানও কমেছে বহুগুণ।

পিইসি-জেএসসি ‘পাবলিক’ পরীক্ষা হওয়ার কারণে অভিভাবকরা এর ফলাফলকে খুব গুরুত্বের সাথে দেখছেন। ১০ বছরের একটি শিশু পিইসি পরীক্ষার গুরুত্ব না বুঝলেও তার অভিভাবক ভবিষ্যতে সন্তানের একটি ভালো চাকরির জন্য সম্ভব সবকিছুই করার চেষ্টা করছেন। তথাকথিত সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতির কারণে পড়া মুখস্থ করানোর জন্য স্কুলে শিক্ষকদের আর বাসায় মা-বাবার চাপে কচি মুখগুলো পেরেশান।

শহর কিংবা গ্রাম-সবখানে একই চিত্র। ফলে শিক্ষাব্যবস্থা হয়ে পড়েছে পরীক্ষাকেন্দ্রিক। পরীক্ষা নামক বোঝার কারণে পড়ালেখা নিয়েই ভীত হয়ে পড়েছে কোমলমতি শিশুরা।

এবার জাতীয় স্বপ্ন ২০৪১ সালের উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ এবং আন্তর্জাতিক কমিটমেন্ট এসডিজি বাস্তবায়নে শিক্ষা মন্ত্রণালয় মানসম্মত ও দক্ষতা নির্ভর কারিগরি শিক্ষার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে।

সরকার কারিগরি শিক্ষাকে মেইনস্ট্রিমিং করার লক্ষ্যে নবম ও দশম শ্রেণিতে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য একটি করে ট্রেড কোর্স বাধ্যতামূলক করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।

শিক্ষামন্ত্রী জানান, ১০ শ্রেণি পর্যন্ত ১০টি বিষয় ঠিক করা হয়েছে। সেগুলোই সবাই পড়বে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে গিয়ে ঐচ্ছিক বিষয়গুলো পড়বে শিক্ষার্থীরা। অর্থাৎ বিজ্ঞান, মানবিক, বাণিজ্যে বিভাজন হবে উচ্চমাধ্যমিক থেকে।

প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থায় বড় ধরনের সংস্কার আসছে। পঞ্চম শ্রেণি সাময়িকী পিইসি, অষ্টম শ্রেণি সাময়িকী জেএসসি নামে পাবলিক পরীক্ষা বাতিল করার সিদ্ধান্ত এসেছে।

পাশাপাশি নবম ও দশম শ্রেণিতে মানবিক, বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা নামে বিভাগ তুলে দেওয়া হচ্ছে। একটি সমন্বিত পাঠ্যক্রম থাকবে এই পর্যায়ে। এখন থেকে তিনটি পাবলিক পরীক্ষা হবে। দশম, একাদশ এবং দ্বাদশ শ্রেণি শেষে পরীক্ষায় বসবে শিক্ষার্থীরা।

শ্রেণি সমাপনী পরীক্ষা এসএসসি আর একাদশ ও দ্বাদশ সমাপনী পরীক্ষার ফলাফল মিলিয়ে প্রকাশ করা হবে এইচএসসির ফল।

মন্ত্রী জানান, নতুন শিক্ষাক্রমের পাইলটিং শুরু হবে আগামী বছর। এ ক্ষেত্রে প্রাথমিকে প্রথম শ্রেণি আর মাধ্যমিকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পাইলটিং শুরু হবে। আর প্রয়োগ শুরু হচ্ছে ২০২৩ সালে।

২০২৫ সাল নাগাদ প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের সকল শ্রেণিতে নতুন পাঠ্যক্রম প্রয়োগ শুরু হবে। নতুন পাঠ্যক্রমে নবম ও দশম শ্রেণির বিভাজন আর থাকছে না। তাদের কারিগরি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।

প্রসঙ্গত, চলতি বছর থেকেই পর্যায়ক্রমে নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদান শুরুর সিদ্ধান্ত ছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। এজন্য প্রস্তুতিও নেয়া হয়েছিল। করোনা সংক্রমণের কারণে শেষ পর্যন্ত সেটা সম্ভব হয়নি। পরে সেটা পিছিয়ে নেওয়া হয় ২০২২ সালে। কিন্তু করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় এই সিদ্ধান্ত থেকেও সরে আসে মন্ত্রণালয়।

সর্বশেষ সিদ্ধান্ত হয়েছে-২০২৩ সাল থেকে প্রথম, দ্বিতীয় এবং ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণি, ২৪ সালে তৃতীয়, চতুর্থ এবং অষ্টম, নবম শ্রেণি ও ২৫ সালে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নতুন শিক্ষাক্রমে বই পড়বে।

এনসিটিবি সূত্র জানিয়েছে, জাতীয় শিক্ষাক্রমে সর্বশেষ পরিবর্তন আনা হয়েছিল ২০১২ সালে। এর আগে ১৯৯৫ ও ১৯৭৬ সালে আরো দুবার শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করা হয়। চলতি ২০২১ সাল থেকে জাতীয় শিক্ষাক্রমে ব্যাপক পরিবর্তন আনার কথা ছিল। কিন্তু করোনার কারণে বদলে যায় সর্বশেষ কারিকুলাম বাস্তবায়নের শুরুর সময়ও।

নতুন শিক্ষাক্রমের খুঁটিনাটি জানিয়ে এনসিটিবির সদস্য (মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক ড. মো. মশিউজ্জামান  বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমে বদলে যাবে বই, বইয়ের ধরন ও পরীক্ষা পদ্ধতিও।

এ ছাড়া শিখন কৌশলেও নানা পরিবর্তন আসবে। এখন যেভাবে মুখস্থবিদ্যা চলছে, নতুন শিক্ষাক্রমে সেটি একেবারেই অনুপস্থিত থাকবে। অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে যে শিক্ষাক্রম আসছে তা আয়ত্তে আনতে হলে শিক্ষার্থীদের তাৎক্ষণিক মেধার প্রয়োগ বাড়বে।

তিনি নতুন শিক্ষাক্রমের উদাহরণ দিয়ে বলেন, রাঙ্গামাটিতে আনারস বেশি উৎপাদন হয়। এত দিন কৃষিবিজ্ঞান বইয়ে কীভাবে আনারস চাষাবাদ করা যায় তা শেখানো হয়েছে।

কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমে রাঙ্গামাটির শিক্ষার্থীদের আনারসের অর্থগুণ, পুষ্টিগুণও শিখতে হবে এবং প্রকল্পভিত্তিক শিক্ষায় যুক্ত হতে হবে। এ ছাড়া থাকবে অ্যাসাইনমেন্ট, থাকবে গ্রুপভিত্তিক শিক্ষা।

শিক্ষাক্রমে করোনা ঢুকছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অবশ্যই। তবে কোন ক্লাসের পাঠ্যবইয়ে করোনা নামের অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত হবে তা এখনো ঠিক হয়নি বলে জানান তিনি।

নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখায় বলা হয়েছে, প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শ্রেণিকক্ষে মূল্যায়ন হবে। এদের কোনো বার্ষিক পরীক্ষা হবে না। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে শ্রেণিকক্ষে ৭০ শতাংশ নম্বরের মূল্যায়ন হবে এবং বার্ষিক পরীক্ষা হবে ৩০ শতাংশ নম্বরের।

ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণিতে শ্রেণিকক্ষে ৬০ শতাংশ নম্বরের মূল্যায়ন হবে এবং বার্ষিক পরীক্ষায় ৪০ শতাংশ নম্বরের মূল্যায়ন হবে।

আর একাদশ, দ্বাদশ শ্রেণিকক্ষে ৩০ শতাংশ নম্বরের মূল্যায়ন হবে ও বার্ষিক পরীক্ষায় ৭০ শতাংশ নম্বরের মূল্যায়ন হবে। এর ফলে দেশের প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষাক্রমে বড় পরিবর্তন হচ্ছে।

অবশ্য শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর আগে ২০১০ সালে করা জাতীয় শিক্ষানীতির অনেক বিষয় এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামর্থ্য, শিক্ষকদের যোগ্যতাসহ সবকিছু বিবেচনা করে শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন আনতে হবে।

নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জও আছে বলে মনে করেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কেউ কেউ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের উচ্চ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, বর্তমান সময়ের বাস্তবতা এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন বিষয় মাথায় নিয়ে এ শিক্ষাক্রম করা হচ্ছে। এটি বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ আছে। তবে সবার সহযোগিতায় এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করতে চান তারা।

এনসিটিবি সূত্রমতে, নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা অর্জনের ওপর জোর দেয়া হয়েছে।

সাধারণভাবে বলা হয়, একজন শিক্ষার্থীর জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা সমন্বিতভাবে অর্জিত হলে তার যোগ্যতা গড়ে ওঠে। উদাহরণ দিয়ে এনসিটিবি বলেছে, একজন শিক্ষার্থী একটি গাড়ি কীভাবে চালাতে হয়, তা যখন বই পড়ে বা শুনে বা দেখে জানতে পারে, তখন তার জ্ঞান অর্জিত হয়।

ওই শিক্ষার্থী যদি গাড়ির বিভিন্ন যন্ত্র হাতে-কলমে পরিচালনা করতে শেখে, অর্থাৎ সামনে, পেছনে, ডানে-বাঁয়ে চালাতে পারে, ব্রেক করতে পারে, তখন তার দক্ষতা তৈরি হয়।

আর যদি ওই শিক্ষার্থী গাড়ি চালিয়ে নিজের ও রাস্তার সব মানুষ, প্রাণী ও সম্পদের নিরাপত্তা রক্ষা করে গন্তব্যে পৌঁছানোর সক্ষমতা অর্জন করে, তখন তার গাড়ি চালনার বিষয়ে যোগ্যতা অর্জিত হয়।

নতুন জাতীয় শিক্ষানীতিতে এসব বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তবে চ্যালেঞ্জ হবে ধারাবাহিক মূল্যায়ন নিয়ে। এজন্য শিক্ষকদের আরো যোগ্য করে তুলতে হবে এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button